১০০ ডলারে ল্যাপটপ। প্রতিটি শিশুর তরে ল্যাপটপ। প্রকল্পটি দারুণ, ভাবনাটাও চমৎকার। বিশ্বব্যাপী প্রশংসা আর সুনাম যেন প্রকল্পটির উদ্দ্যোগী অধ্যাপক নেগ্রোপন্টেকে পৌঁছে দেয় আকাশচুম্বী সাফল্যে। কিন্তু এত সব আয়োজন আর স্বপ্নের যে সলিল সমাধি ঘটবে তা তথ্যপ্রযুক্তি বোদ্ধারা আগেই অনুমান করেছিলেন। লড়ছিলেন নেগ্রোপন্টে একাই। স্বপ্নটা মোটেও সহজ ছিলো না। অধ্যাপক নেগ্রোপন্টে অবশ্য প্রকল্পটির মাধ্যমে সুনাম কুড়িয়েছেন বিশ্বব্যাপী। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে অপেক্ষায় রেখেছেন বিলাসী স্বপ্নের ঘোরে। ফলাফল আবারো দরিদ্র সমাজের তরে নেওয়া মহতী এক প্রকল্পের সলিল সমাধি। প্রশ্ন তাই, দরিদ্র সমাজের জন্য নেওয়া সব প্রকল্পেরই কি এমন মৃত্যু প্রত্যাশিত?

বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো অলাভজনক প্রকল্প ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড ফাউন্ডেশনের (ওএলপিসি) মুখপাত্র জর্জ সেনেল নিশ্চিত করেছেন ১০০ ডলার ল্যাপটপের দাম ১৮৮ ডলারে পৌঁছে গেছে। সর্বশেষ দামের অবস্থানটি ছিল ১৭৬ ডলারের কোটায়। ডলারের দাম ওঠানামাসহ নিকেল ও সিলিকনের দাম বেড়ে যাওয়ায় ১০০ ডলারের ল্যাপটপ প্রকল্পটি বর্তমানে ১৮৮ ডলারে পৌঁছে গেছে। ওএলপিসি প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নেগ্রোপন্টেও ১০০ ডলার ল্যাপটপের দাম দ্বিগুণ হওয়ার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এক্সও ল্যাপটপটি (১০০ ডলার ল্যাপটপের নামান্তর) ডিজাইনরত অবস্থা থেকেই দাম বাড়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাটি বাস্তবে রূপ নিলো। যদিও প্রকল্পের উদ্যোক্তা নেগ্রোপন্টে বরাবরই অভিযোগটিকে গুজব বলে জানাচ্ছিলেন।

এক্সও ল্যাপটপটি বাজারজাতকরণ নিয়ে ইতিমধ্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। আগামী অক্টোবর থেকেই বিশ্বের চাহিদা অনুপাতে উৎপাদন কাজ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্পের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থেকে বিষয়টি এখনো সুনিশ্চিত করা হয়নি। এক্সও ল্যাপটপটি এখনো আছে কারিগরি ও শৈল্পিক সম্পাদনা বিভাগে। তাছাড়া ল্যাপটপটি অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে এখনো চলছে পরীক্ষামূলক পর্যালোচনা। যাদের উদ্দেশে ল্যাপটপটি তৈরি হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তাদের স্বপ্নেই কশাঘাত পড়তে চলেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল তা কয়েক দফা হোঁচট খেলো। সুতরাং ল্যাপটপটির জন্য অপেক্ষারত লাখ-কোটি দরিদ্র সমাজের জন্য এটি না স্বপ্নবিলাস প্রকল্পে পরিণত হয়।

বিলাসী কল্পনা
বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনের অন্যতম মহতী এক উদ্যোগ নেগ্রোপন্টের ১০০ ডলারের ল্যাপটপ। তবে বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের জন্য নেওয়া মহৎ পরিকল্পনাটি বর্তমানে নানাবিধ প্রশ্নবাণে জর্জরিত। প্রকল্পের বিলাসী ও অবাস্তবতা নিয়ে বহু আগেই কঠোর সমালোচনা করেছিলো প্রযুক্তি জায়ান্ট ইন্টেল। প্রতিষ্ঠানটির বিপরীতমুখী আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নেগ্রোপন্টে জানিয়েছিলেন, ১০০ ডলারের ল্যাপটপের প্রসেসর ডিজাইনে কাজ করেছে ইন্টেলের অন্যতম বাজার প্রতদ্বন্বী এএমডি। সে কারণেই বাজারে কিছুটা বৈরী প্রভাব বিস্তারে ইন্টেল ১০০ ডলার ল্যাপটপ প্রকল্পকে সমালোচিত করছে।

অপরদিকে ইন্টেলের অভিযোগটি যে একেবারেই অসত্য ছিল না তা প্রমাণ হয়ে গেল। উল্লেখ্য, গত ৩১ মে ল্যাপটপটি (১০০ ডলারে) বাজারে আসার কথা থাকলেও আগেই আড়াই লাখ ল্যাপটপের যে অগ্রিম অর্ডার জমা পড়েছিল তার বর্তমান বাজার মূল্য দু’দফা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৮ ডলার। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তা ১০০ ডলারে (৫০ ইউরো) বিপণন করার উদ্যোগ ছিল। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়েই বইছে সমালোচনা আর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ঝড়।

ইন্টেলের ভবিষ্যৎবাণী
ইনটেল সূত্র থেকে আগেই নিশ্চিত করা হয়েছিল ল্যাপটপটির বাজার মূল্য বর্তমানে ২০০ ডলার (১০০ ইউরো) কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আগের প্রচার অনুযায়ী ল্যাপটপটির বাজার মূল্যর বৈষম্য প্রকল্পটির বিপণন ও সুনামের পথে প্রতিন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির বাজার বিশ্লেষকদের ভাষ্য, প্রসেসর নির্মাতা এএমডি আর ইন্টেলের রেষারেষিটা পুরনো। একে অন্যের পেছনে লেগে থাকার অভিযোগটাও চমকে দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা সিবিএসকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক নেগ্রোপন্টে জানান, প্রকল্পটির শুরু থেকেই নানামুখী সমালোচনার তোপে পড়েছে। তবে সমালোচনা করলেও অনেক প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রকল্পটির মতো প্রকল্প তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছেন।

সূচনা থেকে ইতি
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে প্রকল্পটির মহল পরিকল্পনা সাজানো হয়। এছাড়া উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের মাঝে আজও অদৃশ্যমান এক ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। প্রযুক্তি জ্ঞানই পারে ব্যবধানটি কমাতে। সে লক্ষ্যেই প্রকল্পটির হাতেখড়ি, যা প্রকাশ পায় সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটির সম্বেলনে। তবে প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য আগামী দু’দশকের মধ্যেই উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বিরাজমান কারিগরি শিক্ষার অবসান রচনা।

তথ্যপ্রযুক্তির বৈষম্য
প্রাযুক্তিক বৈষম্য দহর করতে প্রতিনিয়তই উচিত কম মূল্যের প্রযুক্তি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ। উল্লেখ্য, জানুয়ারি-২০০৫ থেকে নেগ্রোপন্টের ১০০ ডলারের ল্যাপটপ প্রকল্প (ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড) নিয়ে চর্চা চলছিল। ল্যাপটপটির খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গেই ১ কোটি অগ্রিম অর্ডার আসে। বিশ্বের শিশু জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই বৈদ্যুতিক (পাওয়ার) প্রযুক্তির সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত। সুতরাং তাদের জন্য মাত্র ২ ওয়াট ক্ষমতার ল্যাপটপটি তৈরি ছিল যুগান্তকারী প্রয়াস।

জেনেভায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটির আসরে নেগ্রোপন্টের ১০০ ডলারের ল্যাপটপের খবরটি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। প্রযুক্তি অঙ্গনে নিয়মিত বিরতিতেই আসবে প্রযুক্তির নিত্যনতুন খবর। সে খবরে মাতব গোটা বিশ্ব, এমনটাই তো সবার প্রত্যাশা। সে অর্থে নেগ্রোপন্টের ১০০ ডলারের ল্যাপটপ প্রকল্পটি বিশ্বজুড়েই প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। তবুও প্রশ্ন ছিলো, ১০০ ডলার মূল্যের ল্যাপটপটি কি শুধু শিশুদের জন্য, নাকি অন্যদের বরাতেও জুটবে সুফল।

সরকারি খাতে বরাদ্দ
ল্যাপটপগুলো প্রতিটি দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। প্রাথমিকভাবে এটি শুধু সরকারিভাবে বরাদ্দ করা হবে। প্রতিটি দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করবে বিপণন প্রক্রিয়া। তাছাড়া বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বরাদ্দ শেষ হলে তবেই মিলবে অন্যদের কোটা। অর্থাৎ অন্য সব আগ্রহীদের অপেক্ষা করতে হবে আরো বছর খানেক। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে, প্রত্যাশী সবার কাছে এক সময় পৌঁছবে ল্যাপটপটি। এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ল্যাপটপটি পৌঁছতে বছরের বেশি সময় লেগে যাবে।

প্রকল্পের শেষ কোথায়
নেগ্রোপন্টে, ইনটেল আর এএমডি ত্রিমুখী লড়াইয়ে প্রকল্পটি অনেকটা বাধাগ্রস্ত। প্রকল্পটি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুদে কারিগরি শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে নির্মিত। তাই বাজার তারতম্যের অভিযোগটি নেগ্রোপন্টে যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে ফেলবেন এমনটাই সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা। অচিরেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফোটাবে ১০০ ডলার ল্যাপটপ প্রকল্প স্বপ্নটি যেন বাস্তবতার আশীর্বাদপুর্ন হয়। তা না হলে প্রাযুক্তিক বৈষম্য দূরীকরণে সফল এক উদ্যোগের আবারো সলিল সমাধি ঘটবে।

সর্বশেষ সংবাদ
ওয়েব ব্রাউজারের পাশাপাশি ওয়ার্ড প্রসেসর ও আরএসএস রিডার হিসেবেও ল্যাপটপটি কাউকেই নিরাশ করবে না। ল্যাপটপ সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত যে কোনো তথ্য জানতে যে কেউ http://www.olpcnews.com এ সাইটে প্রবেশ করতে পারেন। ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড নিউজ ডটকম খ্যাত ওয়ানা ভোটা জানান, ল্যাপটপটির আবহ ভোক্তাদের দারুণ এক অভিজ্ঞতার সন্মুখীন করবে। এটা শুধু লিনাক্সনির্ভর নয়, শুধু মাইক্রোসফটনির্ভর নয় কিংবা অ্যাপেলনির্ভর নয়। এটি হবে কোটি কোটি ক্ষুদে ব্যবহারকারীর জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এক প্ল্যাটফর্ম, যা সবাইকে প্রযুক্তির সার্বিক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে। তবে দেখার বিষয় এখন এটাই যে, এটি বিশেষ করে যাদের জন্য নির্মিত তাদের কাছে কতটা জনপ্রিয় আর গ্রহণযোগ্য হয়।