ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ার বছর
২০০৭ সালে জিপিআরএস মডেম প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেট-সেবা দেওয়া শুরু করেছে দেশের একাধিক মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এতে ইন্টারনেট দেশের প্রায় জায়গায় পৌঁছে গেছে। আর ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়াটাও হয়েছে সহজ। জিএসএম ও সিডিএমএ−দুই ঘরানার মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এখনো এর খরচ অনেক বেশি, তবু এর মাধ্যমে ইন্টারনেটের বিস্তৃতি বাড়াটা জরুরি ছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখ। তবে এ সংখ্যা এখনো মোট জনসংখ্যার মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ধরে নানা কথা, নানা আলোচনার পর ২০০৭ সালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টেলিফোন করার সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) বৈধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন গত বছর ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসট্যান্স টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিসেস (আইএলডিটিএস) নীতিমালা ঘোষণা করে। উন্নুক্ত ডাকের মাধ্যমে তিন ধরনের লাইসেন্স দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া অনেকখানি এগিয়েছে। দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে শুরু করে বছরের শেষ পর্যন্ত অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ করার ব্যাপক উদ্যোগ দেখা গেছে।
২০০৭-এ বারবার আলোচনায় এসেছে সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেবলের সংযোগ প্রসঙ্গটি। সাগরতলে থাকা সাবমেরিন কেবলের মূল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের তার বারবার কাটা পড়ায় বিঘ্নিত হয়েছে দেশের ইন্টারনেট ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিবার তার কাটার পর ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন থেকেছে। তার বেশি কাটা পড়েছে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সংযোগে। তার কাটার পর সীমিত আকারে কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট-ব্যবস্থা চালু থেকেছে। এই সংযোগের একটি বিকল্প সংযোগ রাখার বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও বছরের শেষ দিন পর্যন্ত বিকল্প সংযোগ চালু হয়নি। বছরের শেষ মাসে দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিটিটিবি একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
ইন্টেলের ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড কর্মসুচির উদ্বোধন করতে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এসেছিলেন শীর্ষ প্রসেসর নির্মাতা ইন্টেল করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. ক্রেইগ ব্যারেট। বাংলাদেশে তাঁর সফর ও ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড কর্মসুচির উদ্বোধন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উৎসাহের সঞ্চার করেছে। ইন্টেল বাংলাদেশে তারহীন ওয়াই-ম্যাক্স প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেটের অবকাঠামো, শিক্ষার জন্য স্থানীয় বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) তৈরি ইত্যাদিতে সহায়তা করবে।
২০০৭ সালেও কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা। তবে জুন মাসে ঘোষিত চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কম্পিউটারে আমদানি শুল্ক আরোপ করা হলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। চুড়ান্ত বাজেটে অবশ্য এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন হলো কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কের জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এর বাস্তবায়ন ২০০৭ সালেও হয়নি। একই সঙ্গে কারওয়ান বাজারে আইসিটি ইনকিউবেটরের সমস্যাগুলোর সমাধান গত বছরও হয়নি।
তথ্য প্রযুক্তির আলোচিত ঘটনা ২০০৭
ভোটার পরিচয়পত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেই নির্বাচন কমিশন কম্পিউটার-তথ্যভান্ডারনির্ভর ভোটার ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ণের উদ্যোগ নেয়। গত বছর ভোটার তালিকা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। এ কাজে ১৪ হাজারেরও বেশি ল্যাপটপ কম্পিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইলেকট্রনিক ভোটদান পদ্ধতি
বুয়েটের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র তৈরি করে গত বছর। এই যন্ত্র দিয়ে ভোটার শনাক্ত করা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা−অর্থাৎ নির্বাচনের প্রতিটি ধাপ সুচারুভাবে করা সম্ভব। এই যন্ত্র দিয়ে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে কি না, সে ব্যাপারে গত বছর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
ল্যাপটপের ব্যবহার বেড়েছে
বিশ্বখ্যাত প্রায় সব নির্মাতার তৈরি ল্যাপটপ কম্পিউটার ২০০৭ সালে ৫০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যাওয়ার কারণে এর ব্যবহার বেড়েছে বাংলাদেশে। এখন শুধু পেশাজীবী বা করপোরেট নির্বাহীরাই নন, শিক্ষার্থীদের হাতেও দেখা যায় ল্যাপটপ কম্পিউটার। ল্যাপটপের পাশাপাশি হাতের তালুতে এঁটে যাওয়া পারসোনাল ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্টের (পিডিএ) জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এসব পিডিএতে এখন মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুবিধাও থাকছে। গত বছর ছিল বাংলাদেশে পিডিএ ফোনের চাহিদা তৈরির বছর। নকিয়ার এনসিরিজ, এইচপি আইপ্যাক, আসুস, ওটু, এইচটিসি ইত্যাদি পিডিএর বাজার বেশ ভালোই ছিল।
মোবাইল ফোন সেবায় বাড়তি মাত্রা
মোবাইল ফোন এখন আর শুধু কথা বলার যন্ত্র নয়। গান শোনা, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, এফএম রেডিও শোনা−নানা রকম কাজে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সেটের প্রযুক্তি যেমন উন্নত হচ্ছে, তেমনি মোবাইল ফোন-সেবাতেও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। ২০০৭ সালে গ্রাহকদের জন্য ওয়েলকাম টিউন, নিত্যনতুন রিংটোন, এসএমএসের মাধ্যমে নানান তথ্য জানার সুবিধা, বাংলা গেম, মাল্টিমিডিয়া ফাইল আদান-প্রদান ইত্যাদি সেবা ছিল উল্লেখ করার মতো।
এসিএম-আইসিপিসির আঞ্চলিক পর্বে সফলতা
গত কয়েক বছর ধরেই চীনের নাম ছিল এক নম্বরে। এবারে পৃথিবীর সবেচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা এসিএম আইসিপিসির ঢাকা পর্বে শীর্ষস্থানটি অর্জন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্বিতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এটি ছাড়াও একাধিক আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ২০০৭-এ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা-পরামর্শে তথ্যপ্রযুক্তি
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা পরামর্শ সহায়তায় তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারে সফলতা পেয়েছে আমাদের গ্রাম উন্নয়নের তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প। বাগেরহাটের গ্রামের নারীদের জন্য স্তন ক্যান্সার নিরীক্ষণ, পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা শুরু করলেও ২০০৭ সালে এ কার্যক্রম ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও খুলনা বিস্তৃত হয়। রোগীদের সব তথ্য কম্পিউটার-তথ্যভান্ডারে রাখা হয়, এরপর সেটি নিজেদের বানানো সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর আন্তর্জাতিক স্তন গবেষণা কেন্দ্রে। সেখান থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত আসে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মার্কিন ও বাংলাদেশি চিকিৎসকেরা মিলিতভাবে রোগীদের পরামর্শ দিতে পারেন।
প্রযুক্তি পুরস্কার পেল সেলবাজার ও গ্রামীণ শক্তি
বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান সেলবাজার ও গ্রামীণ শক্তি গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির টেক মিউজিয়াম পুরস্কার পেয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেনাবেচার অভিনব উদ্ভাবনের জন্য সেলবাজার ও দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসারে অবদান রাখায় গ্রামীণ শক্তি এ পুরস্কার পায়।
উইকিম্যানিয়ায় বাংলাদেশ
ইন্টারনেটে সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া নিয়ে বাংলাদেশে সচেতনতা ২০০৭ সালে আরও বেড়েছে। এ বছর আরও নতুন নিবন্ধ যোগ হয়েছে বাংলা উইকিপিডিয়া। গত বছরই প্রথমবারের মতো উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ লেখকদের সম্মেলন উইকিম্যানিয়ায় যোগ দেয় বাংলাদেশ। বেলায়েত হোসেন এতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
জোরালো মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলন
মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলন আরও জোরালো হয় গত বছর। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক ও অঙ্কুর বিশেষ অবদান রাখে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলও মুক্ত প্রোগ্রামিং সংকেতভিত্তিক ইউনিকোড সমর্থিত একটি বাংলা সফটওয়্যার প্রকাশ করে, যা ভোটার পরিচয়পত্র তৈরির কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। দেশে গত বছর প্রথমবারের মতো সফটওয়্যার স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়, সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে।
৪০ হাজার তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ
গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে দরকারি তথ্য পৌঁছে দিতে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য গত বছর গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক (বিটিএন)। এই সংগঠন বছরের শেষ মাসে মিশন ২০১১ নামে একটি কর্মসুচির ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি সাল ২০১১ নাগাদ ৪০ হাজার টেলিসেন্টার চালু করা এ কর্মসুচির অঙ্গীকার।
বিজয়ের পেটেন্ট মোস্তাফা জব্বারের
জনপ্রিয় বাংলা সফটওয়্যার বিজয়ের উদ্ভাবক হিসেবে পেটেন্ট পেয়েছেন মোস্তাফা জব্বার। বিজয় কি-বোর্ডেরও পেটেন্ট পেয়েছেন তিনি। দেশে কোনো সফটওয়্যার পণ্যের পেটেন্ট করার ঘটনা এ-ই প্রথম।
ডিভি লটারিতে সরব সাইবার ক্যাফে
অভিবাসন ভিসার জন্য ডিভি লটারি ২০০৯-এর প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছরের শেষভাগে অনলাইন লটারির মাধ্যমে আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। যেহেতু আবেদন করার পুরো ব্যাপারটিই ছিল ইন্টারনেটভিত্তিক, তাই সাইবার ক্যাফেগুলো এ সময়টাতে ছিল সরগরম। অনেকে ডিভি লটারির ফরম পূরণ করতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসেবা-ব্যবসায়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়েছেন।
আলোচিত বিষয়গুলি গ্রন্থনা করেছেন প্রথম আলো পত্রিকার সহকারী সম্পাদক জনাব পল্লব মোহাইমেন এবং ছাপা হয়েছিলো গতকালকের প্রথম আলোতে।