Tags

, , , , , , , , , , , , , ,

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে মাঝেমধ্যে যেমন হইহই পড়ে যায়, একইভাবে প্রযুক্তি খাতেও মাঝেমধ্যে রইরই পড়ে যায়। আর সেই সুযোগে ঘোলা পানিতে কেউ কেউ আমাদের অসহায় মানুষগুলোকে ঠকিয়ে প্রচুর টাকা বানিয়ে সটকে পড়েন। বর্তমান সময়ে আবার তেমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে কলসেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স প্রদান করতে যাচ্ছে; এবং বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শত কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সক্ষম হবে। এমনও বলা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে ছাড়িয়ে যাবে। এ ধরনের কথা প্রচারিত হওয়ার পর, অনেকেই ই-মেইল ও ফোন করে জানতে চেয়েছেন, কীভাবে তাঁরা এই শত কোটি ডলারের ভাগিদার হতে পারেন। তাঁদের জন্য এই কলসেন্টার ব্যবসার কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাস বেশি দিনের ইতিহাস নয়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে কম্পিউটার জনপ্রিয় হতে শুরু করে। আর নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকেই দেশে একটি হুলস্থুল পড়ে যায় এই বলে যে, বাংলাদেশ ডাটা এন্ট্রি কাজ করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করতে পারে। সেই হইহই মিছিলে আমরা অনেকেই যোগ দিয়েছিলাম। দীর্ঘ এক দশক ধরে সেটা চলল। তখন বলা হলো, দেশে সাবমেরিন কেব্ল নেই। তাই এই ব্যবসাটি ঠিকমতো হচ্ছে না। অনেকে বললেন, যদি ভিস্যাট উন্নুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সেই ব্যবসা করতে পারব। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ভিস্যাট উন্নুক্ত করে দেওয়া হলো। কিন্তু আমাদের সেই ডাটা এন্ট্রি ব্যবসার কিছুই হলো না। অনেকেই ভিওআইপির (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট) ব্যবসা শুরু করে দিলাম। দেশ কোটি কোটি ডলার উপার্জনের বদলে হাজার কোটি ডলার হারিয়ে ফেলল।

ডাটা এন্ট্রির স্বপ্ন শেষ হওয়ার পর শুরু হলো মেডিকেল ট্রান্সক্রিপ্টের ব্যবসা। আমেরিকার ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র ক্যাসেট থেকে শুনে শুনে কম্পিউটারে এন্ট্রি করার কাজ হলো এটি। আমরা সেটাও করতে পারিনি। কিন্তু এই ডাটা এন্ট্রির কাজে চাকরির সুযোগ দেওয়া হবে, এই কথা বলে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হলো। বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি পার্টনার নিয়ে সেই লুটপাটে অংশ নিল।

তারপর এই শতকের শুরুতে শুরু হলো সফটওয়্যার রপ্তানির ব্যবসা। কিছু কিছু লোক বাজারে প্রচার করতে শুরু করল, বাংলাদেশ সফটওয়্যার রপ্তানি করে ভারতের মতো শত কোটি ডলার উপার্জন করতে পারে। পুরো জাতি তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েকটি ভারতীয় প্রশিক্ষন কেন্দ্র বাংলাদেশে এসে পাড়ায় পাড়ায় দোকান খুলে বসল। তারপর আমাদের হাজার হাজার মানুষকে ঠকিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা নিয়ে এই দেশ থেকে চলে গেছে।
এখন কলসেন্টারের নামে আবারও শত কোটি ডলারের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে দেশের মানুষকে। কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। যাঁরা ভাবছেন কয়েকটি টেলিফোন লাইন আর ইন্টারনেট নিয়ে কিছু স্নার্ট ছেলেমেয়েকে বসিয়ে দিলেই একটি কলসেন্টার করা যাবে, তাঁরা একটি মূর্খ গন্ডির ভেতর বাস করছেন। বর্তমান সময়ের কলসেন্টারকে আর কলসেন্টার বলা হয় না, বলা হয় কনটাক্ট সেন্টার। আর এগুলো এখন হয়ে গেছে আরো পরিশীলিত। এখন আর শুধু কথা বলে কলসেন্টার হয় না, সেখানে যোগ হয়েছে ডাটা, ভিডিও, চ্যাট, পুশ টু টক, কল-ব্যাক, প্রেজেন্স ইত্যাদি। বাংলাদেশে কনটাক্ট সেন্টার ব্যবসার বড় চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করছি।

  • প্রথম সমস্যা হলো সময়। আমরা এই ব্যবসায় অনেক দেরিতে নামতে যাচ্ছি। এই ব্যবসায় ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ অনেক দুরে চলে গেছে। ওই সব দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন নতুন করে ব্যবসায় নামতে গেলে প্রচন্ড প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে। সেই প্রতিযোগিতায় থেকে কোনো ক্রেতা জোগাড় করা খুবই কঠিন হবে।
  • দ্বিতীয় সমস্যা হলো, রাজনৈতিক। কলসেন্টার হলো একটি সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওখানে সেবা গ্রহণকারীর সমস্যা তখনই সমাধান করে দিতে হবে। কোনো একটি কলসেন্টার যদি রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে, তাহলে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কলসেন্টার রাখবে না। কলসেন্টার প্রতিষ্ঠার আগেই এগুলো পরীক্ষা করা হবে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ব্যাপারে আমাদের মোটেও সুনাম নেই।
  • তৃতীয় সমস্যা হলো, টেলি-যোগাযোগ। বর্তমানে বাংলাদেশে যে অপটিক্যাল ফাইবার আছে, সেটা প্রায়শই কাটা পড়ে। আর সেটা ঠিক করতে অনেক সময় এক দিন লেগে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কলসেন্টার ভারত কিংবা বাংলাদেশে হলেও, ‘ডাটা সেন্টার’ কিন্তু আমেরিকাতেই থাকবে। তখন দ্রুত গতির ইন্টারনেট না থাকলে কলসেন্টারগুলো ব্যর্থ হবে। যতদিন এই যোগাযোগব্যবস্থা ১০০ ভাগ নিশ্চিত না হচ্ছে, ততদিন এই ব্যবসা সফলতা লাভ করবে না।
  • চতুর্থ সমস্যা হলো, ভালো ইংরেজি জানা লোকবল। ভারতের একটি বড় সুবিধা হলো, তাদের ইংরেজি জানা বিশাল জনগোষ্ঠি। ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যোগাযোগব্যবস্থা আর ইংরেজি জানা ছেলেমেয়ের প্রতুলতার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনোভাবেই তুলনা করা যাবে না। কলসেন্টারগুলো এশিয়াতে যায় মূলত আমেরিকা, ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়া থেকে। আমেরিকার ইংরেজি আমরা অনেকটা বুঝলেও, ব্রিটিশ আর অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজি বোঝা এবং একই তালে কথা বলাটা তিন মাসের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাই যাঁরা এই ব্যবসায় নামছেন, তাঁদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে।
  • পঞ্চম সমস্যা হলো, বিদ্যুৎ। যদি জেনারেটরের তেল পুড়িয়ে কলসেন্টার চালাতে হয়, তবে খরচ বেড়ে যাবে। আবার যদি সাবমেরিন কেবলের পাশাপাশি ভিস্যাট রাখতে হয়, তাহলেও সেটা ব্যয়সাপেক্ষ হবে। যদি ভিস্যাট দিয়ে কেউ কলসেন্টার চালাতে পারত, তাহলে এতদিনে বাংলাদেশে কলসেন্টার চলে আসত।
  • ষষ্ঠ সমস্যাটি হলো, আকার। এই ব্যবসাটি কিন্তু আকারের ওপর নির্ভরশীল। এখানে ১০-১৫ জন মানুষ খাটিয়ে খুব একটা সুবিধা হবে না। আমেরিকাতে একেকটি কলসেন্টারে তিন-চার হাজার লোক কাজ করে। বাংলাদেশে তত বড় না হলেও, দুই-তিন’শ লোকের ব্যবস্থা না হলে, সেটা ব্যবসায়িকভাবে সফল হবে বলে মনে হয় না।
  • সপ্তম সমস্যাটি হলো, সেবার মনোভাব। সেবা যে একটি পণ্য, এই ধারণাটিই আমাদের ভেতর এখনো ভালোভাবে জন্ন নেয়নি। তার ওপর আছে সরকারি খবরদারি আর চাঁদাবাজি (সরকারি ও বেসরকারি)। এমন ধরনের পরিবেশে সেবাশিল্প প্রসার হয় না।

দেশে যদি সত্যি সত্যি তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে সুবিধা নিতে হয়, তাহলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। আর সেই পরিকল্পনাকে সবাই মিলে বাস্তবায়ন করতে হবে। সকল সরকারকে সেটার পেছনে সমর্থন দিতে হবে। এমন একটি জোরালো প্রতিজ্ঞা না থাকলে, বারবার এমন হুজুগ তৈরি হবে, আর কিছু তস্কর এসে আমাদের নিরীহ মানুষগুলোকে লোভ দেখিয়ে পকেট খালি করে নিয়ে যাবে।

তবে অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। আমি শুধু বলতে চাইলাম, কাজটি খুবই কঠিন। আর এই হুজুগে পড়ে কেউ যেন প্রতারিত না হন। চাকরির ট্রেনিং, ব্যবসার ট্রেনিং কিংবা যেকোনো কিছু করার আগে, একটু বুঝেশুনে নেবেন। আর কেউ এটাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে প্রতারিত করছে কি না সেটা সরকারের পক্ষ থেকে একটু খেয়াল রাখতে পারলে ভালো।

জাকারিয়া স্বপন: তথ্য প্রযুক্তিবিদ
সিলিকন ভ্যালি, যুক্তরাষ্ট্র
zs [এট] zswapan.com