শুরুতেই অবাক করেছিল এর বিশালতা। মেলা প্রাঙ্গণের একটি প্যাভেলিয়ন থেকে অপরটিতে যেতে প্রয়োজন পড়েছিল বাস কিংবা কারের। বিশ্বের ৭৭টি দেশ থেকে অংশ নিয়েছে ৫৮৪৫টি প্রতিষ্ঠান। আর তাই নামের সাথে এর বিশেষণটা বেশ যায়, সেটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্য প্রযুক্তি মেলা। নাম তার সিবিট। ১৯৮৬ সাল থেকে জার্মানির হ্যানোভারে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মেলা। এবারের ৬ দিনের এই প্রযুক্তি উৎসব শুরু হয়েছিল ৪ মার্চ, চলেছে ৯ মার্চ পর্যন্ত।
পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি
পৃথিবীতে বাড়ছে মানুষ। কমছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা তথা সবুজ পরিবেশ। আর এসবের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মানুষের জীবনযাপনের ওপর। তাহলে উপায় কি? মানুষকেতো অবশ্যই বাঁচতে হবে, আর ঠিক সে জন্যই বাঁচতে হবে প্রকৃতিকে। জার্মানির সিবিট মেলাতেও গুরুত্ব পেয়েছিল বিষয়টি। এ জন্য মেলার থিম ছিল না আইটি, সহজ করে বলতে গেলে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি।
পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি তৈরি করতে গিয়ে উদ্ভাবকরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের দিকে। আর তাই সিবিটের গ্রীন আইটি ভিলেজে গিয়ে দেখা মিললো নতুন এক মনিটরের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয় ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বন্ধ করলেও মনিটরটি বন্ধ করতে ভুলে যায়। অথচ মনিটরও কিন্তু কম বিদ্যুৎ খায় না। নতুন উদ্ভাবিত মনিটরটি সেক্ষেত্রে বেশ স্মার্ট। কম্পিউটার বন্ধ করার সঙ্গে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে মনিটরটি। ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে অনেক। ইউরোপীয়ান প্রতিষ্ঠান ফুজিৎসু-সিমেন্স যৌথভাবে তৈরি করছে এই মনিটর। কথা হচ্ছিল ঐ প্রতিষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজার মার্ক ওয়েসকেম্প এর সঙ্গে। তিনি বললেন, আমরা এমন ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চাচ্ছি যেটা বিদ্যুৎও সাশ্রয় করবে। পরিবেশ বাঁচানো অবশ্যই জরুরি তবে ব্যবসার দিকটাও দেখতে হবে। সুতরাং আমাদের শ্লোগান হচ্ছে ভালো বিশ্বের জন্য ব্যবসা। নতুন উদ্ভাবিত পণ্যগুলো কিছুটা দামি। তবে যে কেউ বছরখানেকের মধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করবে। এই মনিটর কিন্তু সহসাই পাওয়া যাবে না এশিয়া’র বাজারে। অপেক্ষা করতে হবে অন্তত বছর দু’য়েক।
গ্রিন আইটি ভিলেজে দেখা মিললো ক্লাইমেট সেভারস নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ইন্টেল, গুগল, মাইক্রোসফট, এইচপি’র মতো নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় তৈরি হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি তৈরিতে পরস্পরকে সহায়তা করা। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি ক্লাইমেট সেভারস এর কমিউনিকেশন ম্যানেজার বারবারা গ্রিমস এর সঙ্গে। তিনি বললেন, ক্লাইমেট সেভারস হচ্ছে একটি উদ্যোগ যেটাতে পরিবেশকে বাঁচাতে নামকরা তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ইত্যাদিকে একত্রিক করা হয়েছে। আমরা প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করছি।
গ্রিন আইটি ভিলেজ সিসকো, বিটকমসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সবারই লক্ষ্য একটি, পরিবেশ বাঁচাতে হবে, সঙ্গে ব্যবসাও। তবে গ্রিন আইটি ভিলেজের এসব আয়োজন কেন যেন পছন্দ হচ্ছিল না মার্কো মাসিক এর। জার্মানির মিউনিখ এর এই ব্যবসায়ী বললেন, আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র গ্রিন আইটি দেখার জন্য। কারণ মিডিয়া বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। কিন্তু আমি এখানে এসে খুবই দুর্বল কয়েকটি প্রকল্প দেখলাম। ফলে কিছুটা হতাশ হয়েছি। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয় এটা নতুন একধরনের ব্যবসা। তবে বিদ্যুৎ বা শক্তি সংরক্ষণের কিছু উপায় বের হলে মন্দ কি।
তার মতো আরো কয়েকজন গ্রিন আইটি ভিলেজ সম্পর্কে কিছুটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেন। এটা কি আসলেই পরিবেশ বাঁচানো নাকি নতুন কোনো ব্যবসার ফন্দি তা নিয়ে চিন্তিত অনেকে। তবে সমালোচনা যাই থাক, সিবিট এর মাধ্যমে গ্রিন আইটি নামে যে উদ্যোগটা শুরু হলো তা পরিবেশ বাঁচাতে কিছুটা ভূমিকা রাখবে বৈকি।
ক্রেজ কিন্তু মোবাইল ফোন
বিশ্বজুড়ে এখন তারুণ্যের ক্রেজ মোবাইল ফোন সেট। আর সেটাই জানান দিল সিবিটের মোবাইল প্যাভেলিয়ন। ব্ল্যাকবেরি, সনি এরিকসন, টি মোবাইল এর মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলো জড়ো হয়েছে মোবাইল প্যাভেলিয়নে। সনি এরিকসন গুরুত্ব দিচ্ছে তাদের নতুন মিউজিক সিরিজের মোবাইল ফোনসেটগুলোর ওপর। আর তাই তাদের স্টলে শুধু মিউজিক আর মিউজিক। টি মোবাইল অবশ্য মার্কেটিং করেছে আইফোন এর। আর ব্ল্যাকবেরি ব্যস্ত নতুন সফটওয়্যার নিয়ে।
আগামী’র প্রযুক্তি
মেলায় ঘুরতে ঘুরতেই দেখা গেল নরওয়ের প্রতিষ্ঠান টেলেনরকে। বাংলাদেশে টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের ৬২ শতাংশ শেয়ারের মালিক এই প্রতিষ্ঠানটি। নতুন এক টেকনোলজি নিয়ে মোলায় হাজির তারা। মেশিন টু মেশিন কমিউনিকেশন, মানে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করবে আরেক যন্ত্রের সঙ্গে। আরেকটু সহজ করে দেই। ধরুন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোনো এক জায়গায় দুর্ঘটনায় পড়লো একটি গাড়ি। টেলেনরের এই প্রযুক্তি যুক্ত থাকলে গাড়িটি নিজে থেকেই যোগাযোগ করবে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ এবং হাসপাতালের সঙ্গে। ফলে উদ্ধার কাজ করা যাবে বেশ দ্রুত। বিষয়টি নিয়ে টেলিনরের এক মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে জানালেন, আজকে সবার কাছে মোবাইল ফোন আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে মেশিনকেও যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতে হবে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে মেশিন টু মেশিন যোগাযোগও সহজলভ্য হয়ে যাবে। মেলায় আরেকটি আকর্ষণ ছিল ব্রেইন চালিত কম্পিউটার। মাথায় একগাদা তার পেঁচিয়ে বসে থাকতে দেখা গেলো একজনকে। সে কিছুক্ষণ পর পর মনিটরের দিকে তাকাচ্ছিলো আর তাতেই কম্পিউটার বুঝতে পারছিল ব্যক্তিটির আকাঙ্খা। তবে এই ব্রেইন চালিত কম্পিউটার এখনো রিসার্চ পর্যায়ে আছে। পুরোমাত্রায় কাজ করতে সক্ষম হতে সময় লাগবে নাকি আরো পাঁচ বছর।
চীনদের জয়জয়কার
মেলায় ঢুকে প্রথমেই একটু থমকে যেতে পারেন আপনি। যেদিকে যাবেন সেদিকেই চীনা নাগরিক। প্যাভেলিয়নগুলোতে চীনাদের স্টল। হবেই না বা কেন? এবারের সিবিটে শুধু চীন থেকে অংশ নিয়েছে ৫০০টি প্রতিষ্ঠান, এককভাবে কোনো দেশের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ এটি। আর তাই সিবিট প্রাঙ্গন এখন ছোটখাট এক চীনা শহরে রূপ নিয়েছে। অবশ্য সিবিট মেলায় এবারের থিম কান্ট্রি ছিল ফ্রান্স। তবে তাদের ছাপিয়ে চীন নিয়েই মাতামাতি বেশি ছিল।
সিবিটে বাংলাদেশ
সিবিট মেলা কেমন লাগছে? জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মোরছালিন জুয়েল এর কাছে। তিনি বললেন, খুব ভালো লাগছে। জুয়েলের এই এক কথার জবাবের সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশ থেকে আসা অপর ব্যবসায়ী এম মঞ্জুরুর রহমান। জানালেন, সিবিটে আমি পর পর তিনবার এসেছি। গতবারের তুলনায় এবার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে সিবিট একটি নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আটকে গেছে।
তবে বাংলাদেশ কেন জানি তথ্য প্রযুক্তি খাতে এগুতে পারছে না কোনোভাবেই। আর তার প্রভাব পড়েছে সিবিট মেলাতেও। প্রতি বছর সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। এ বছর এসেছে মাত্র দু’টি প্রতিষ্ঠান। তাও আবার সরাসরি নয়, সুইস প্রতিষ্ঠান সিপ্রো’র ব্যানারে। কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশ থেকে আসা লিডস সফট এর সহকারী মার্কেটিং ম্যানেজার আনিসুর রহমান খান এর সঙ্গে। তিনি জানালেন, সিবিট মেলা জার্মানিতে হয়। এখানে খরচের একটি ব্যাপার আছে। আর তাই এককভাবে একটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই মেলায় যোগ দেওয়া বেশ কঠিন। বাংলাদেশ সরকার এবং সফটওয়্যারের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিস যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে সিবিটে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে।
তবে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হলেও ভারত কিন্তু বেশ অগ্রসর ছিল সিবিটে। প্রথম দিনেই খোঁজ মিললো অন্তত গোটা পঁচিশেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের। ভারতের নানান রাজ্য থেকে এসেছে তারা। তাদের সবারই নজর নতুন ক্রেতার দিকে। ইউরোপের বাজারে ভারতের তথ্য প্রযুক্তি পণ্য আরো ঢুকাতে বদ্ধপরিকর তারা। কথা হচ্ছিল তাদেরই একজন, ওয়েব ওয়ার্কস এর ম্যানেজার নিশাত রতি’র সঙ্গে। তিনি জানালেন, দক্ষ জনশক্তি আর ইংরেজিতে দক্ষতা আমাদেরকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে।
পুরো হ্যানোভার জুড়ে ছিল সিবিটের আমেজ। হোটেল-মোটেল কিংবা গেস্ট হাউজ- সবই কানায় কানায় পূর্ণ। আর তাই থাকার জায়গা না পাওয়ায় বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের একটি বড় অংশ এখন রাত কাটিয়েছে হ্যানোভারের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে, একই বাড়িতে। তবে অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। হ্যানোভারের বাসিন্দাদের বাড়তি উপার্জনের একটি ভালো রাস্তা এটি। হ্যানোভারের পরিবেশও কিন্তু বেশ রহস্যময়। কখনো প্রখর রোদ্দুর, কখনো তুষারপাত। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাসাত। তবে এরই মধ্যে জমে উঠেছিল সিবিট। মাইক্রোসফট, ইয়াহু আর গুগলের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধের রেশ পাওয়া যাচ্ছিলো প্রথম দিন থেকেই। ঘুরতে ফিরতেই দেখা মিলেছে বিশ্বের নামজাদা সব তথ্য প্রযুক্তিবিদের সঙ্গে। এবারের সিবিটে সব মিলিয়ে ভিজিটরের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। আগামী বছর সিবিট মেলা শুরু হবে ৩ মার্চ, আর চলবে ৮ মার্চ পর্যন্ত।
দৈনিক ইত্তেফাকের জন্য-
আরাফাতুল ইসলাম, হ্যানোভার (জার্মানি) থেকে
তোমরা আমার ইজ্জত নিয়া টানাটানি করবার লাগছো কেন ? আমার ব্লগ নাই কে কইলো ? আমার ব্লগ (www.voiceofsouth.org)। এইটা বাংলা লেখা তাই অমি আজাদের ব্লগে দিলাম। তাছাড়া অমিতো ভালো ছেলে, তার ব্লগে লিখতে সমস্যা কোথায়?
হাঃ হাঃ হাঃ
আমার মনেহয় সোহাগ ভাই মজা করে প্রশ্ন করেছিলেন এবং আমিও মজা করে উত্তর দিলাম। 🙂
লেখাটা অনুমতি সাপাক্ষেই দেয়া হয়েছে…
অমি
আমি শুরুটা দেখে মনে করলাম তুমিই মনে হয় জার্মানি গেছ। শেষে দেখি অন্য নাম। আর সবার মতো আমিও একটু বোকা হয়ে গেছি।
আলমগীর