আমাদের দেশে মোবাইল এসেছে ১৯৯৩ সালে। তখন এশিয়ায় বাংলাদেশ বাদে জাপান আর কোরিয়ারয় শুধু মোবাইল চলতো। যে কোম্পানীটি সাহস করে আমাদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়েছিলো সেটা হচ্ছে সিটিসেল। বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া অনেকগুলি দূর্নীতির মধ্যে সিটিসেল একটি।

এর ইতিহাস একটু বলা দরকার। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকম নামে একটি কোম্পানীকে লাইসেন্স দেয়া হয়। অনেক কাঠ খড় পুড়ে অপারেশনে আসতে না পারলে ১৯৯০ সালে হাচিসন বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করে এবং ব্যাপক চেষ্টার পরে ১৯৯৩ সালে অপারেশনে আসে সিটিসেল। তখন বাংলামটর মোড় থেকে চারিদিকে ৫০ কিলোমিটার জুড়ে তাদের মোবাইল কাজ করতো।

এরপরে বাংলাদেশ টেলিকমের মালিকরা প্যাসিফিক মটরস্ নাম দিয়ে আবার হাচিসনের কাছ থেকে ৫০% শেয়ার কিনে নেয় ঐ বছর ডিসেম্বরের দিকে। তিন বছর ধরে AMPS নামের ৩য় শ্রেণীর সেবা বিক্রি করে এসেছে বিত্তবানদের কাছে। তখন শুধু অবৈধ টাকার মালিকরাই মোবাইল ব্যবহার করার সাহস করতে পারতেন। এই মোবাইল আবার অবৈধ টাকা রোজগারের উপায়ও করে দিয়েছে অনেককে। তখন সচিবালয়ের গেটে মোবাইল নিয়ে দাঁড়ালে কোন কৈফিয়ত না দিয়েই ভেতরে যাওয়া যেতো। 🙂

এর পরে ১৯৯৬ সালে যখন অন্যান্য অপারেটর বাজারে পাল্লা দিতে সমস্যা হচ্ছিলো, তখন সিটিসেল হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ নাম পরিবর্তন করে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ রাখে।এত ভালো প্রযুক্তি হওয়ার স্বত্ত্বেও সিটিসেল মানুষ সেরকম একটা গ্রহণ করেনি। কারন সিটিসেল জালিয়াতির চরমে ছিলো সেই সময়। সেগুলির মধ্যে নম্বর চেপে সেন্ড বাটন চাপ দিলেই বিল চাপিয়ে দেয়া (অপর প্রান্তে কল রিসিভ করুক আর না করুক), জোড়া তালি দিয়ে নেটওয়ার্ক চালানো, এসএমএস সুবিধা না থাকা, ইত্যাদী উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে সিটিসেল বিটিটিবির মাইক্রোওয়েভের ঘাড়ে পা দিয়ে চট্টগ্রামে নাটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে এবং যারা ঢাকায় মোবাইল ব্যবহার করেন, এরা যদি ভুল করে মোবাইল নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে ব্যবহার করেছেন, তাহলেই হয়েছে। কুড়াল দিয়ে কোপ দিতে বসেছিলো সিটিসেল একেকটা কলের জন্য। আসতেও বিল দিতে হবে এবং করলেও বিল দিতে হবে। মাফ নাই। আর ফোন আসলে ধরবেন না, সেটা হবে না। আপনার মোবাইল যতক্ষণ বাজবে, সেটারও বিল আপনাকে দিতে হবে।

এরই মধ্যে সিটিসেল দেখতে পেলো GSM অপারেটররা অনেক এগিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে পেছনে ফেলে দিয়ে। আর ঢাব্বা ঢাব্বা সেট মানুষ আর চালাতে চাইছে না। তখনই সৌভাগ্যক্রমে (!) সিটিসেলের মূল ভবনে আগুন লেগে যায় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে তারা সার্ভিস আপ করে ফেলে। সেটা ১৯৯৯ সালের কোনো এক সময় হবে।

এরপরে সিটিসেল CDMA One প্রযুক্তি নিয়ে আসে। সবসময়ই সিটিসেলের লক্ষ্য ছিলো কিভাবে অল্প পুঁজি বিনিয়োগে বেশী লাভ করা যায়। CDMA প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অল্প টাওয়ার অনেক বেশী কাভারেজ এবং ভয়েস কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারে যা GSM পারেনা। অবস্থাভেদে GSM গ্রাহকের বাড়ীতে বাড়ীতে টাওয়ার লাগাতে হয়। অনেকে বলে সিটিসেলে যে আগুন ধরে গিয়েছিলো, ইস্যুরেন্স কোম্পানী তার ভর্তুকি দিয়েছে, সেই টাকা দিয়ে সিটিসেল নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসে। আসলে বাস্তবটা অন্যরকম। ফুজিৎসু তখন নতুন CDMA মালপত্র তৈরী করেছিলো, সেগুলি পরীক্ষা করার জন্য গিনিপিগ দরকার, তাই সিটিসেলে ইনভেস্ট করতে আসে তারা। পারফরমেন্স একেবারে খারাপ তা-না, তবে এদের মাল ব্যবহার করে সিটিসেল আরেক দফা ভুল করেছে। এত কিছু করার পরেও সিটিসেল AMPS এবং CDMA একসাথে কার্যকর রাখে, যার ফলে ভোগান্তি হয় গ্রাহকদের। একেক টাওয়ারে একেক ধরণের নেটওয়ার্ক।

২০০১ সালের এপ্রিল মাসে সিটিসেল নিজেদের ব্যাকবোন তৈরী করে ঢাকা চট্টগ্রামে যোগাযোগের জন্য। এরই মধ্যে অন্য অপারেটরগুলি দেশের অর্ধেক নিজেদের নেটওয়ার্ক ব্যকবোন ব্যবহার শুরু করে দিয়েছিলো। সিটিসেল এদিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলো। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে সিটিসেল সিলেটে নেটওয়ার্ক নিয়ে যায়। এই সম্প্রসারে সাহায্য করে ফুজিৎসু। এবং এই বছর সেপটেম্বর মাসে সিটিসেল রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুরে নেটওয়ার্ক বিস্তার করে বিটিটিবি’র ডিডিএন ব্যবহার করে।

পরের মাসে সিটিসেল প্রথমবারের মত এসএমএস চালু করে (মোবাইল সেবার চালু করার প্রায় ১০ বছর পরে)। কিন্তু সার্ভিস ছিলো হাস্যকর। এখনো সিটিসেলের এসএমএস হাস্যকর। বার্তা গেলে আসে না বা আসলে যায়না। সিটিসেল সবময়ই নোংরা শ্রেণীর হ্যান্ডসেট সরবরাহ করে এসেছে গ্রাহকদেকে। একবার মোটোরোলা 182c সেট বিতরণ করে, সেগুলি ব্রাজিল থেকে চুরি করে আনা। এখন দিচ্ছে হুয়াউই, ইউটিস্টারকম। এগুলি দিয়ে কোনোরকমে কথা বলা যায়। একবার নষ্ট হলে বাংলাদেশের কোনো মেকানিক এগুলি ঠিক করতে চায়না, আর সার্ভিস সেন্টারগুলিতে গেলে সেরকম একটা পাত্তা পাওয়া যায়না। সিটিসেলের সেট নিয়ে গেলে ছিঃ ছিঃ শুনতে হয়।

এর মাঝে রিলায়েন্স ইন্ডিয়া মোবাইল সিটিসেল কিনতে চায় এবং পরে গ্রাহকের অবস্থা দেখে আর আসেনি। পরে সিঙ্গাপুর টেলিকম আলটিমেটাম দেয়, এতদিনের মধ্যে এত গ্রাহক করতে পারলে তারা চিন্তা ভাবনা করবে। আর তথনই আসে লোভনীয় সব অফার এবং সিটিসেল সিঙটেলের কাছে শেয়ার বিক্রি করতে সক্ষম হয়। সিঙটেল এসে প্রথমে সিটিসেলের বাতুলা টেকনলোজি বাদ দিয়ে GSM-এ যেতে চায়। কিন্তু পরে কাস্টমারের কথা ভেবে বাতুলা জিনিসপত্র বাদ দিয়ে CDMA 2000 1x প্রযুক্তিতে আসে। পুরাতন সব কিছু বাদ দিয়ে চাইনিজ মালপত্র লাগিয়ে রাতারাতি সারা দেশে প্রতিটা থানায় নেটওয়ার্ক বিস্তার করে।

প্যাকেজের ক্ষেত্রে সিটিসেলে বৈসম্য দেখা যায়। এ যেনো হিন্দু মুসলমানের ধর্ম বৈসম্য! যেটা অন্য কোনো অপারেটরে নেই। প্রিপেইড দু’টি প্যাকেজের মধ্যে আকশ পাতাল বিলের তফাৎ। এই মুহুর্তে সিটিসেলের “হ্যালো তোমাকে” নামের একটি প্যাকেজ বাজারে আছে, যেটিতে বাংলাদেশের সব প্রি-পেইড প্যাকেজের চাইতে সাশ্রয়ী কল-চার্জ। কিন্তু আর ব্যবহারকারীরা কি দোষ করলো? আপনার মোবাইলে বিটিটিবি যোগাযোগ সুবিধা থাকলেই আপনি পাপ করে ফেলেছেন, সবচাইতে কলচার্জ আপনার বেশী।

গতবছর প্রিমিয়াম নামের একটি পোস্টপেইড প্যাকেজ আনে বাজারে। এখন এটার কলচার্জ বাংলাদেশের অন্য সব অপারেটরের চাইতে বেশী। মাঝে মাঝে ঝাঁকি দিয়ে কিছু সাময়িক কিছু সুবিধা দিলেও বেশীরভাগ সময়ই এই কোম্পানী গ্রাহকদের ক্ষতি করে এসেছে। সিটিসেলে যত প্যাকেজ বৈশম্য আছে তা বাংলাদেশের অন্য কোনো মোবাইল অপারেটরে নাই।

বর্তমানে সবগুলি মোবাইল অপারেটরে মোবাইলের পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা আছে। সিটিসেলে একমাত্র 3G প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও গত বছর শেষ দিকে ইন্টারনেটের সুবিধা উপস্থাপান করে গ্রাহকদের কাছে। কিন্তু এই ইন্টারনেট এত মূল্যবান যে আপনার মনে হবে আমেরিকায় ISD কল করে ইন্টারনেট ব্যবহার করি। এরকম হাস্যকর সেবা উপস্থাপনের যুক্তি কি কারই বোধগম্য নয়। CDMA 1x প্রযুক্তির ইন্টারনেটের গতি খুবই চমৎকার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রিলায়েন্স এবং টাটা দু’টি কোম্পানী CDMA 1x চালায় এবং দু’জনই খুব সুন্দর ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু সেবা ভালো হলে যে কুড়াল দিয়ে কোপ দিয়ে টাকা নিতে হবে এরকম কথা নেই�%