বিশ্বের শীর্ষ মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের চেয়ারম্যান বাংলাদেশে আসছেন এমন খবর কিছু দিন ধরে খবরের কাগজগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছিল। হতদরিদ্র এ দেশে তিনি এলে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাত সমৃদ্ধ হবে, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক বসবে, এ দেশ অনেক কম্পিউটার পাবে এমন কথাবার্তা আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদরা পর্যন্ত বেশ জোর গলায় বলছিলেন। এমনকি একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের ফাঁকা খবর বেশ কায়দা করে ছেপে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল খোদ ইন্টেল করপোরেশনকেও। যাদের এ দেশে ২ টাকা বিনিয়োগ করার আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, তারা এ দেশে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে তখন তা হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বৈকি।

তার পরও এ দেশে তিনি এলেন, বৈশ্বিক একটি কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে যুক্ত করে তার উদ্বোধনও করলেন, কম্পিউটার প্রদানের আশ্বাস দিলেন, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বললেন, কৃষির উন্নতির কথা শোনালেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের আশাবাদ জানিয়ে রাখলেন। এ সবই কেবল আমাদের প্রাপ্তি। সরাসরি কোনো বিনিয়োগ আমাদের ঘরে এলো না। যে কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে তিনি যুক্ত করলেন তাতে যদি ভিয়েতনাম আমাদের মডেল হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে ইন্টেল থেকে বিনিয়োগ এলেও আসতে পারে। কারণ, কিছু দিন আগে তিনি ভিয়েতনামকেও আগামীর বিশ্ব কর্মসূচিতে যুক্ত করেছিলেন। এরপর তিনি সেখানে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগও করেছেন। ওই বিনিয়োগের ফলে ভিয়েতনামের সামগ্রীক অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যায়। জিডিপি বেড়ে গেছে সেখানে।

জাতিসঙ্ঘ গ্লোবাল অ্যালায়েন্সের আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট’র চেয়ারম্যান ও বিশ্বখ্যাত মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেল করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. ক্রেইগ আর ব্যারেট গত মঙ্গলবার ঢাকায় যে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন তার নাম, ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড প্রোগ্রাম বা আগামীর বিশ্ব কর্মসূচি। এই সাথে বাংলাদেশ ইন্টেলের বিশ্বব্যাপী এ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হলো। এ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার জন্য তিনি ১৬ ঘন্টার এক সংক্ষিপ্ত সফরে সস্ত্রীক ঢাকা আসেন। এটাই ছিল তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যে তিনি সকালে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। সেখানে তিনি প্রধান উদেষ্টার ত্রাণ ও উন্নয়ন তহবিলে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন। এর পরে তিনি হোটেল রেডিসনে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর তিনি হোটেল শেরাটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বলেন, আমি এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রায় ৩০টি দেশে গিয়েছি। ওই দেশে গিয়ে মনে হয়েছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের জীবনযাত্রা মান উন্নত করতে পারে। বাংলাদেশে এসে আমার মনে হয়েছে, এ দেশের কৃষকরা কৃষির তথ্য পেতে বেশি আগ্রহী। তিনি বলেন, স্খানীয় ভাষায় এ রকম মানসম্পন্ন তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা প্রয়োজন যা সবার কাজে লাগবে। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষাবিদ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী নেতা, বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মীরা উপস্খিত ছিলেন। পরে দুপুরে তিনি দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী বারবার ব্যারেট।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে ৩৫টি দেশে ইন্টেল ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ হলো এ প্রোগ্রামের ৩৬তম দেশ। উচ্চগতির তারহীন ইন্টারনেটের জন্য ওয়াই-ম্যাক্স প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে কম্পিউটার বিতরণ, প্রশিক্ষণ, কনটেন্ট ইত্যাদি রয়েছে ইন্টেলের এ কর্মসূচির মধ্যে। ইন্টেলের তৈরি নতুন ধরনের কম্পিউটার অর্থাৎ ক্লাসমেট পিসি ছাত্রছাত্রীদের কাছে সহজে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ইন্টেল ও গ্রামীণ সলিউশনস এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এবং সাশ্রয়ী এই ল্যাপটপ বা ক্লাসমেট পিসি প্রজেক্টনির্ভর শিক্ষার জন্য অনন্য ভূমিকা রাখবে। এ কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণের জন্য কোনো হার্ডডিস্ক নেই। তথ্য সংরক্ষণের জন্য আছে মেমোরি কার্ড। দুই থেকে ৪ গিগাবাইটের মেমোরি কার্ড এ কম্পিউটারে ব্যবহার করা যাবে। এখন ক্লাসমেট পিসির দাম পড়বে ২৬০ ডলার। আগামী দুই বা তিন বছরের মধ্যে তা ২০০ ডলারে পাওয়া যাবে।

আগামী তিন বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে প্রায় ১ হাজার ক্লাসমেট পিসি বা কম্পিউটার অনুদান দেবে ইন্টেল। ড. ব্যারেট জানান, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই ইন্টেল আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় পিসি ল্যাবরেটরি স্খাপনের জন্য কম্পিউটার প্রদান করবে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বা অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা নেই বলে জানান ব্যারেট। তিনি বলেন, গ্লোবাল অ্যাহেড প্রোগ্রাম পরিচালনা করতে গত ৫ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। চলতি বছর এ খাতে খরচ হবে ১০০ মিলিয়ন ডলার। যেহেতু বাংলাদেশও এখন এ প্রোগ্রামের অংশ, তাই এ দেশ ওই প্রোগ্রাম থেকে অনুদান পাবে। প্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরি করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিগত বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে ইন্টেল। এতে করে ওইসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করবে ইন্টেল। এই কার্যক্রমের সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গসংগঠন গ্রামীণ সলিউশনস ও ইন্টেলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ সলিউশনস প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ইন্টেল এবং গ্রামীণ সলিউশনস পারস্পরিক সহাযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা, প্রযুক্তি, সফটওয়্যারের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ইন্টারনেট ব্যবহার সহজলভ্য করতে একযোগে কাজ করবে।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে উপস্খিত থাকতে না পারলেও ভিডিওচিত্রে ধারণ করা তার বক্তব্য মাল্টিমিডিয়ায় উপস্খাপনার মাধ্যমে দেখানো হয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা, স্বাস্খ্য ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন কার্যকরী প্রকল্প প্রণয়ন ও সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ স্বল্প সময়ে প্রভূত উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও ইন্টেলের যৌথ পরিচালনা এবং সহযোগিতায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে একই ধরনের সাফল্য আমরাও অর্জন করতে সক্ষম হব।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিৎসা, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহকে দেশব্যাপী জনসাধারণের জন্য আরো সহজ করে তুলতে ইন্টেল ও গ্রামীণ সলিউশনস বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ রকম একটি প্রকল্প হচ্ছে পিসি ওনারশিপ প্রোগ্রাম। যার আওতায় রয়েছে স্বল্পমূল্যে ও স্বল্প পরিমাণ মাসিক কিস্তিতে কম্পিউটার প্রদান। পাশাপাশি, সারা বাংলাদেশে টেলিসেন্টার স্খাপন করা। টেলিসেন্টারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের জন্যও কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি এবং প্রদান করা সম্ভব হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গ্রামীণ সলিউশনসের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে ইন্টেল অ্যাট টেক ও ইন্টেল অ্যাট লার্ন শিরোনামে দু’টি শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইন্টেল অ্যাট টেক প্রকল্পে শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, ক্লাসরুমে ও শিক্ষাকার্যক্রমে কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো দক্ষভাবে শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব। আর কমিউনিটিনির্ভর ইন্টেল অ্যাট লার্ন প্রকল্পের আওতায় ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের প্রযুক্তি ব্যবহার, জটিল ভাবনা ও সমন্বিত শিক্ষা গ্রহণে দক্ষতা অর্জন করার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি বিস্তারে ইন্টেল বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্প খরচে দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার আরো সহজলভ্য হয়ে উঠবে। যদিও বাংলাদেশে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও প্রযুক্তিপ্রেমীরা বলেছেন, ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করে সেটা নিয়ে কাজ করার কথা বলা হচ্ছে কোন ইস্যুতে তা ঠিক আমাদের বোধগম্য নয়। এ দেশের সাধারণ মানুষকে নিষিদ্ধতার বেড়াজালে আটকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে কোনো সুবিধা দেয়ার জন্য ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে নাতো­ বলে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।